হবিগঞ্জের জমিন ধরে ছুটি, বায়ে ঝরে পড়ে ঘোলাটে বিকেল...
পড়ন্ত সে কোমল বিকেলের সামনে সমানে ধুলিধূসরিত আঘুণী ধানখেত
মেঘ নাই, আকাশের নীল নাই, শুধু মাঠে কাটা ধানের শুকনো গোছার সমুদ্র
আহারে শূন্যতা! কী বিশালত্ব তার! কী চাউনি!
সে শুকনো মাঠে, কতগুলো ছেলের ক্রিকেটে মাতে শৈশব, নারকেলের ডাগ্যায় চলে ব্যাটিং
দিগন্ত জোড়া বিস্তর প্রান্তর মেলা বয়েসী উল্লাসে খেলে খালি পায়ের হাফপ্যান্ট কমান্ডোর দল
সে ছোট খেলুড়ের দল না জানি গড়া ক্রোশব্যাপী কত প্রতিবেশী গুনে
আমি জানি, এ শৈশবেরাও যাবে জাদুঘরে, শিগগির, কারণ বাকি পৃথিবীর শিশুরা কড়া যুবক হবে বলে তখনো হয়ত পড়ছে কষে কাগজে কলম-পেন্সিল চষে।
মনে পড়ে প্রমথ চৌধুরীর একখানি চরণ— শৈশবে যে শিশু ছিল না, যৌবনে সে যুবক হতে পারে না।
তবু অসম্ভবের সাধনা চলে সাধন করার চেষ্টায়, রূপকথার দেশে— শিক্ষায়।
ঘাস নাই, গরু নাই, রাখাল নাই, নাই চাষাদের আনাগোনাও
ভীষণ ঘূর্ণাবর্তী পৃথিবীর বুকেও কত এমন থমকে থাকা বিশ্রান্ত দুনিয়ার জানালা খোলা
আইল মেলে দিয়ে ন্যাড়া ধানখেত টুকরো টুকরো, কিছু নেই বাড়তি! তবু কিছু চাই না!
এর মাঝে প্রায়ই দীঘল পথ বয়ে গেছে যত দূর গিয়ে দিগন্ত ছাপায়
দুধারে মরাঘাসের সে দীঘল পথের সরু শাদা দাগ কেটে কোনো বাবার সাংহাই-চায়না সাইকেল ছুটে চলে গোধুলীর দিকে...
ফুলহাতা মলিন শার্ট গতরে, লুঙ্গি হাওয়ায় ফুলে এবড়ো খেবড়ো মাটির হেলকি দুলকি চলুনি—
আহা রে চাষার অবলা দিনগুলি! কত সহজ সাবলীলে অমনি চলে অস্তাচলে।
আহা রে আমার ধানখেতের মেঠোপথ! তুই কেন আরো ধানখেত গড়ালি না?
সেদিন কি হাট-বার? না মনে হয়। কাঁধে পাত্তি-ঝোলানো হাটুরে তো কেউ দেখা দিল না!
কখনো সখনো নেশা ভাঙে দৃষ্টির— মাঠ ধরে গেঁথে গেঁথে টানা তারের খাম্বা। দূরে যায়, কাছে আসে। ফাঁকে ফাঁকে ধরা দিয়ে যায় থোকা থোকা বাড়ি-দ্বীপ।
সাতখান-ছয়খান আইলের বিরতিতে একখান করে পাড়া— সযতনে আঙিনাগুলো আড়াল করে ঘিরে আছে ভিনদেশী ইউক্যালিপটাস,
তালগাছ নেই, বটগাছ নেই এদেশে আর। বাবুই পাখির বাসাও বোধয় চড়ুই পাখির কবিতায়...
কখন হঠাৎ খেয়াল হয় উঁচু উঁচু গাছগুলো ডাল ছুটিয়ে সচকিতে হয়ে গেছে চুঙ্গা চুঙ্গা ইটের ভাটা...
এ নিশ্চিন্ত বিকেল দেখার জন্য কোনো পাখির দলও নাই
বিজন মাঠের পর মাঠ... বিবর্ণ আকাশের তলে হঠাৎ বিরলে
ধর্মজাল খাড়ায়ে ঝুলে নির্জন, নিস্তরঙ্গ খালের পাড়ে, কানাবগীরও ছুটি!
এই দর্শকহীন কোলহলবিহীন নীরব পসরায়, যুগ হারানো খোয়া যাওয়া স্মৃতি, নিভৃত, নির্বিকার পল্লীর
এত আয়োজন!
সবই বৃথা
যদি
আমি না থাকি।
অগ্রহায়ণের শেষ, পৌষের পয়লা দিনে করা খসড়া থেকে। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, ঢাকা থেকে সিলেটে আসার সময়। অবসরগুলো কেউ দিয়ে যাও অযতনে, সযতনে লব থুবায়ে মনমতন। কিছু কিছু শব্দ গ্রামীণ এবং লোকায়ত। এই আঘুণ মাস এলে মার কথা খুব মনে পড়ে। কখনোবা আঘুণ মাসের ছলেও মাকে মনে পড়ে। আমি আঘুণ মাসের, আমার মা— আঘুণ মাসের মা।